ইবনে বতুতা নামটি শুনলেই চোখে ভাসবে অসীম সাহারার কাফেলা কিংবা মধ্য এশিয়ার স্তেপে ছুটন্ত ঘোড়ার অজানা যাত্রা কিংবা ভারতবর্ষে পথ হারানো একলা পথিক কিংবা আরব সাগরের বুকে ঝড়ের কবলে পড়া এক মুসাফিরের গল্প। কিন্তু শুধু কি তাই? তৎকালীন মুসলিম সম্রাজ্যের শাসন, শোষণ, সংস্কৃতি, ধর্মানুভূতি, দর্শন ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসগুলো সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় তার সফর কাহিনীতে। ইবনে বতুতা ও তার সফরের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় নিয়ে এই আর্টিকেল।
জন্ম
ইবনে বতুতা ১৩০৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী বর্তমান উত্তর আফ্রিকার দেশ মরোক্কোর তাঞ্জিয়ার এ জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ। ইবনে বতুতা নামটি তার বংশগত প্রতীক। তার বংশের পূর্বপুরুষরা মিশরের সীমান্তবর্তী যাযাবর জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল।
মোট ভ্রমণ এলাকা
ইবনে বতুতা তার সময়ের প্রায় সমস্ত মুসলিম বিশ্ব এবং এর বাইরেও সুমাত্রা ও চীন ভ্রমণ করেছেন। সে সময়ের মুসলিম বিশ্ব বলতে কেবল আরব অঞ্চল বুঝালে ভুল হবে। মধ্য এশিয়া (তুরস্ক, ইউক্রেন ও রাশিয়ার ককেশীয় অঞ্চল), আন্দালুসিয়া (স্পেন), উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা (মালি, মৌরিতানিয়া, আলজেরিয়া, পশ্চিম সাহারা), আরব সাগরের কোলঘেঁষা আফ্রিকান অঞ্চল (সোমালিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া) এবং ভারতীয় উপমহাদেশ সে সময় কোনো না কোনো মুসলিম সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি প্রায় ৭৫০০০ মাইল বা ১২০০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেন। যন্ত্রনির্ভর যুগের আগে শুধুমাত্র উট, ঘোড়া, পালতোলা বণিকের ডিঙ্গায় কিংবা পায়ে হেঁটে এতোটা পথ অতিক্রম করা কেবল কল্পনাতেই সম্ভব।

ভ্রমণের শুরু
ইবনে বতুতা মাত্র একুশ বছর বয়সে হজ্জ পালনের জন্য পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পথে কোনো ভ্রমণকারীকে না পেয়ে তাকে একাই চলতে হলো।
যাত্রাপথে তিনি তিউনিসে দুইমাস অবস্থান করেন এবং সেখানে এক উকিলের মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। এরপর তিনি বর্তমান লিবিয়ার ত্রিপলিতে এসে পড়েন এবং সেখানে পুনরায় বিয়ে করেন।
মক্কায় যাত্রাপথে তার সাথে বোরহানুদ্দিন ও শেখ মুর্শিদি নামক দুইজন ধর্মীয় পন্ডিতের সাক্ষাৎ হয়। মূলত তাঁদের থেকেই তিনি ভ্রমণের অনুপ্রেরণা পান।
ইবনে বতুতার স্বপ্ন ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা
মক্কাভ্রমণের পথে আলেকজান্দ্রিয়ায় তার সাথে ধর্মীয় বুজুর্গ শেখ মুর্শিদির সাক্ষাৎ ঘটে এবং তিনি সেখানে তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সেখানে থাকাকালীন ইবনে বতুতা যে স্বপ্ন দেখেন তার বিবরণ,
“বিরাটাকার এক পাখির ডানায় চড়ে আমি মক্কার দিকে উড়ে চলেছি, সেখান থেকে ইয়েমেন, ইয়েমেন থেকে পূর্বদিকে, তারপর কিছুদূর দক্ষিণে গিয়ে দূর পূর্বাঞ্চলের দিকে এবং সর্বশেষ নামলাম কালো ও সবুজ এক দেশে।“
স্বপ্নের বিবরণ শুনে শেখ মুর্শিদি ব্যাখ্যা করলেন,
“তুমি মক্কায় হজব্রত করবে, মদিনায় হজরতের রওজা মোবারকও জিয়ারত করবে। তারপর সফর করবে ইয়ামেন ও তুর্কীদের দেশ ইরাকে, সেখান থেকে যাবে ভারতে। ভারতে আমার ভাই দিলশাদের সাথে দেখা হবে।ভারতে তোমাকে অনেকদিন কাটাতে হবে । সেখানে গিয়ে তোমার মুসিবত হবে এবং আমার ভাই দিলশাদ তোমাকে সেই মুসিবত থেকে উদ্ধার করবে।“
এরও প্রায় অনেক বছর পর দিল্লীর সুলতানের পত্র ও উপহার নিয়ে চীনদেশের বাদশাহর নিকট ইবনে বতুতাকে পাঠানো হয়। পথিমধ্যে কিছু দস্যু আলজালালী নামক শহর আক্রমণ করলে সেখানে তাদের সাথে যুদ্ধ হয়। এরুপ অবস্থায় ইবনে বতুতা বিচ্ছিন্ন হয়ে দস্যুদের কাছে বন্দি হন। অনেক ঘটনার পর তিনি মুক্তি পান এবং একলা পথিক হিসেবে তিনি ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তিনি খাবার ও পানির অভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েন। ঠিক এই সময় এক অপরিচিত ব্যক্তির সাহায্যে তিনি তার এই বাজে পরিস্থিতি থেকে কাটিয়ে উঠেন। পরবর্তীতে ইবনে বতুতা বুঝতে পারেন এই অপরিচিত লোকটিই হলো দিলশাদ যার কথা শেখ মুর্শিদি তাকে বলেছিলেন।
পারস্য ভ্রমণ ও ২য় হজ্জ
১ম হজ্জ শেষে ইবনে বতুতা আলী (রা) এর কবর জিয়ারত করেন। এরপর তিনি পারস্য তথা বর্তমান ইরাক ইরান অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা গমন করেন। তার বর্ণনায় মঙ্গোলদের আঘাতে পর্যদুস্ত বাগদাদের চিত্র ফুঁটে উঠে। এরপর তিনি কুর্দিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখান থেকে একটি কাফেলার সাথে যোগ দিয়ে ২য় বার হজ্জ সম্পাদনা করেন।
আনাতোলিয়া ও কনস্টান্টিনোপল ভ্রমণ
নৌ পথে ভারত গমনে ব্যর্থ হলে ইবনে বতুতার নতুন গন্তব্য হয় মধ্য এশিয়া ও ককেশাস। তিনি আনাতোলিয়ার যুব ভাতৃত্ব সংঘ বা আখিয়ার বেশ প্রশংসা করেছেন। আনাতোলিয়ার প্রতিটি গ্রামে, জেলায় ও শহরে এই সংগঠন দেখা যায়। এরা সম্মিলিতভাবে মেহমানদের আপ্যায়ন করে, অন্যের অভাব দূর করে, অন্যায় অত্যাচার দমন করে। ইবনে বতুতা আনাতোলিয়ার আলায়া, আস্তানিয়া, বলদুর, সাবারতা, কুল হিসার, কুনিয়া, লারান্দা, আক্সারা, বিরগী ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি বিরগীর সুলতানের সাথে দেখা করেন। এরপর তিনি বারসার সুলতান ওরখান বেকের সাথে দেখা করেন। ওরখান বেক ছিলেন ওসমান চাকের পুত্র যিনি অটোমান সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। আনাতোলিয়ার বিশাল অংশ তখন শাসন করতেন সুলতান মুহাম্মাদ উজবেক খাঁ যার তৃতীয় স্ত্রী বায়ালুনের পিতা কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট তাকাফুর। কনস্টান্টিনোপলের তখনকার সময়ে অজেয় এবং নিরাপত্তারক্ষী প্রাচীরবেষ্টিত সবচেয়ে আধুনিক ও সুন্দরতম শহর।

বায়ালুনের অতিথি হিসেবে ইবনে বতুতা কনস্টান্টিনোপল ভ্রমণ করেন। সেখানে বিখ্যাত আয়া সোফিয়া গীর্জাকে তিনি বর্ণ্না করেন,
“গীর্জাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বেরেচিয়ার পুত্র আসাফ যিনি সুলেমানের তুতো ভাই। গ্রীকদের প্রসিদ্ধ গীর্জার মধ্যে এটি অন্যতম। গীর্জাটি দেওয়াল দ্বারা এভাবে বেষ্টিত যে দেখে একটি শহর বলেই মনে হবে। এর তেরটি প্রবেশপথ আছে এবং ঘেরাও করা একটি পবিত্র স্থান আছে। স্থানটি এক মাইল লম্বা এবং একটি মাত্র প্রবেশদ্বার আছে।“
তিনি সেখানকার সম্রাট তাকফুরের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বর্ণ্না করেন।
ভারত ভ্রমণ
১৩৩৪ সালে আফগানের হিন্দুকুশ পর্বতমালা দিয়ে ইবনে বতুতা ভারত প্রবেশ করেন এবং তৎকালীন দিল্লীর সুলতান মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। ইবনে বতুতা ভারতে কাজী হিসেবে নিযুক্ত হোন এবং সেখানকার দুইটি গ্রামের কর থেকে তার আয় বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু জীবনের নতুন মোড়েও অনেক ঝুঁকি ছিল। সুলতান একই সাথে ভয়ঙ্কর ও সহানুভূতির এক মিশ্র চরিত্র ছিলেন। ইবনে বতুতা খেয়াল করলেন তার আশেপাশের মানুষগুলো কম অপরাধের কারণে অধিক শাস্তি পাচ্ছেন, এমনকি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হচ্ছে। অপরদিকে ইবনে বতুতার বিলাসিতা সুলতানের চোখে পড়ে। তাই তিনি মর্যাদাহানি ও জীবননাশের ভয়েও ছিলেন। ১৩৪২ সালে সুলতান তাকে দূত হিসেবে চীনে প্রেরণ করেন। তার সাথে চীনের সম্রাটের জন্য অনেক উপহার সামগ্রী ছিলো। যাত্রাপথে কখনো তিনি দস্যুদলের কাছে বন্দি হোন, কখনো মালাবরে বিভিন্ন লোকাল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং সবশেষে কালিকটে জাহাজডুবির ফলে তিনি সুলতানের দেওয়া সমস্ত উপহার হারিয়ে ফেলেন। তাই সুলতানের ভয়ে তিনি ভারত ছেড়ে মালদ্বীপে গমন করেন এবং সেখানেও কাজী হিসেবে নিযুক্ত থাকেন। তিনি মালদ্বীপের শাসকের পরিবারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। কিন্তু বিভিন্ন বিপত্তির কারণে তিনি মালদ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হোন। সেখান থেকে তিনি শ্রীলঙ্কা যান এবং এরপর তিনি বঙ্গ দেশে যান।
ঝড়ের কবল
মাবার যাওয়ার পথে ইবনে বতুতার জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। সে সময় তিনি জাহাজের উঁচু পাটাতনে আশ্রয়ে ছিলেন। তাঁর বর্ণ্নায়,
“আমার সঙ্গীদের দুইজন, একজন বালিকা গেলো ভেলায় চড়ে আর অপর বালিকাটি গেলো সাঁতার কেঁটে। নাবিকরাও ভেলার সাথে দড়ি বেঁধে সাঁতার কেঁটে চলে গেল। আমি নিজে জাহাজে থেকে গেলাম। ক্যাপ্টেন নিজে হালের সাহায্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। নাবিকেরা চারখানা ভেলা তৈরী করতে আরম্ভ করল। কিন্তু সেগুলো তৈরীর আগেই রাত হলো এবং জাহাজও বোঝাই হলো পানিতে। আমি জাহাজের সবচেয়ে উঁচু পাটাতনটিতে উঠলাম ও ভোর হওয়া অবধি সেখানেই ছিলাম।“
বঙ্গদেশে ইবনে বতুতা
“আমরা পনেরদিন নদীর দুপাশের সবুজ গ্রাম ও ফলফলাদির বাগানের মধ্যে নৌকার পাল তুলে চলেছি, মনে হয়েছে আমরা কোনো পণ্যসমৃদ্ধ বাজারের ভিতর দিয়ে চলেছি।“
এর মাধ্যমে সেসময়ের বঙ্গদেশের সৌন্দর্যের কথা ফুঁটে উঠে। ইবনে বতুতা বলেন এই দেশকে আফগান শাসকরা ধন-সম্পদে পূর্ণ দোজখের সাথে তুলনা করেন। তিনি সর্বপ্রথম এদেশের সাদাকাও অর্থাৎ চট্টগ্রামে নামেন। সেখান থেকে নদী পথে সোনারগাঁও যান। এরপর যান কামারু অর্থাৎ বর্তমান আসাম ও সিলেটে। সেখানে তিনি শাহজালালের সাথে দেখা করেন।
তার বর্ণ্নায় গঙ্গা (পদ্মা), যূন (ব্রক্ষ্মপুত্র) ও আন নাহার উল আয্রাক (সুরমা) নদীর কথা উঠে এসেছে। মেঘনাকে তিনি নীলনদের সাথে তুলনা করেছেন যা হবঙ্ক শহরের পাশে প্রবাহিত এবং এই নদী দিয়ে বাংলা এবং লখনৌ উভয় রাজ্যে প্রবেশ করা যায়।
শাহজালালের আধ্যাত্মিকতা
সিলেটে এসে ইবনে বতুতা ধর্মীয়গুরু শাহজালালের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। সেখানে তিনি শাহজালালের গায়ে ছাগলের লোমের একটি আলখেল্লা দেখতে পান এবং ইবনে বতুতাকে তিনি আলখেল্লাটি উপহার দেন। কিন্তু আশেপাশের দরবেশরা বললেন এই আলখেল্লাটির ব্যাপারে শাহজালাল আগেই ভবিষ্যদ্বানী পেশ করেন। তিনি বলেন,
“মরোক্কোর এক অধিবাসী এই আলখেল্লাটি চেয়ে নিবেন। তাঁর থেকে নিবেন একজন বিধর্মী সুলতান। এটি আমার ভাই সাঘার্জের বোরহানুদ্দিনকে দিবেন। তাঁর জন্যে এটি তৈরী করা হয়েছে।”
তারপর বহুদিন পর চীনের হ্যাং চৌ ফু শহরে ইবনে বতুতার গায়ের আলখেল্লাটি পছন্দ করেন এক চৈনিক সুলতান। অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ইবনে বতুতা এর বিনিময়ে দশটি জামা, একটি ঘোড়া ও জিন এবং কিছু অর্থ গ্রহণ করেন। পরের বছর পিকিং শহরে তিনি বোরহানুদ্দিনের দরগা খুঁজে বের করলেন এবং দেখলেন সেই আলখেল্লাটি গায়ে দিয়ে তিনি পড়তে বসেছেন।
চীন ভ্রমণ
বাংলা থেকে সুমাত্রা ও জাভা হয়ে ইবনে বতুতা চীনের পিকিং শহরে পৌঁছান। তার মতে সম্পদের দিকে প্রতিযোগিতা করতে পারে পৃথিবীতে আর কোনো দেশ নাই। চীনের প্রতিটি শহরে আলাদা মুসলিম মহল্লা রয়েছে এবং চীনের প্রতিটি বাড়িতে স্বর্ণ রৌপ্য অহরহ। কিন্তু তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিরুপ মন্তব্য পাওয়া যায়।
তার সফর কাহিনীতে চীনের সমৃদ্ধ শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়। ইবনে বতুতার মতে চীনের শিল্পের সাথে কেবলমাত্র গ্রীক শিল্পের তুলনা চলে। তার বর্ণনায়,
“যে শহরে সুলতান বাস করেন সেই শহরের চিত্রশিল্পীদের বাজারের মধ্য দিয়ে আমি ও আমার সঙ্গীরা সুলতানের প্রাসাদে গিয়েছিলাম। আমাদের পরণে ছিল ইরাকী পোশাক। বিকেলে প্রাসাদ থেকে ফিরবার পথেই আমার ও আমার সঙ্গীদের ছবি কাগজে এঁকে দেয়ালে ছেঁটে রেখেছে। আমরা তখন একে অপরকে পরীক্ষা করে দেখলাম প্রতিটি ছবি নিখুঁতভাবে আঁকা।“
তিনি এরপর জয়তুন, কানজানফু, হংচৌসহ প্রভৃতি শহর ভ্রমণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে চীনে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে ইবনে বতুতা চীন ত্যাগ করেন।
স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা
চীন থেকে কুয়ানজু ও সুমাত্রা হয়ে তিনি ভারতে আসেন। এরপর ভারত থেকে বাণিজ্যিক জাহাজে মাস্কট হয়ে তিনি বাগদাদ পৌঁছান। সেখানে তার স্বদেশের একজন শেখের কাছে তিনি জানতে পারেন তার পিতা অনেক আগেই মারা গেছেন। তিনি বাগদাদ থেকে দামেস্ক হয়ে আলেপ্পো পৌঁছান। সে সময় আলেপ্পোতে প্লেগ মহামারির কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল। তিনি জেরুজালেম, হেবরন, দামিয়েস্তা, আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে কায়রো পৌঁছান। প্রতিটী শহরই তখন প্লেগ মহামারিতে পর্যদুস্ত। এরপর আবারো মক্কায় হজ্জ পালন শেষে তিনি তার নিজভূমি তাঞ্জিরে ফিরে আসেন। পথিমধ্যে তিনি তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পান।
কিন্তু এখানেই তার সফর শেষ হয় নি। এরপর তিনি বেরিয়ে যান উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও আন্দালুসিয়ার (স্পেন) উদ্দেশ্যে।
কাফ্রীদের দেশে ভ্রমণ
কাফ্রীদের দেশ বলতে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন দেশগুলোকে বুঝিয়েছেন ইবনে বতুতা। তিনি সিজিল্মাসা থেকে ইবলাতানে যান। কিন্তু ইবালাতানে অতিথি আপ্যায়নের করুণ অবস্থা দেখে তিনি নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত চলে আসতে চাইলেন কিন্তু মালী দেশ দেখার জন্য তিনি সামনে এগিয়ে যান। তিনি মালীর সুলতান মানসা সুলেমানের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। সেখানকার খাবার-দাবার তার জন্য খুব বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাড়াল। তিনি সেখানে আলুর তৈরী লাবসী নামক খাবার খেয়ে প্রায় ২ মাস অসুস্থ থাকেন। এরপর তিনি নুবাদের দেশ (আফ্রিকার একদল খ্রীস্টান অধিবাসী) হয়ে তাগাদ্দা, গগো ও বুদা তে যান।

তিনি তার সফরকাহিনীতে অনেক স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীকে জংলীরুপে বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে তিনি আফ্রিকার কিছু মানবখেকো অধিবাসীদের কথা ও সাদা চামড়ার মানুষদের প্রতি সেখানকার মানুষদের বিরুপ প্রভাবও তুলে ধরেন।
কুকুরমুখো মানুষ
Cynocephelus শব্দটি বলতে বুঝায় মানবদেহের মধ্যে কুকুরের মতো মাথা। মিশরের পৌরকাহিনীতে Duamtef, Wepwawet, Anubis দেবতাদের কুকুরমাথার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। অপরদিকে মধ্যযুগীয় অভিযাত্রী গিয়োভানো ডা পিয়ান ডেল কারপিন ও মার্কোপোলোর পাশাপাশি ইবনে বতুতার সফরকাহিনীতে কুকুরের মাথার মতো দেখতে একদল মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি কোনো জায়গায় তাদের বসবাসস্থল। ইবনে বতুতার সফর কাহিনীতে বর্ণিত হয়,
“আমরা বরাহনকদের দেশে এসে পৌঁছলাম। এরা ইতর শ্রেণীর লোক এবং এরা কোনো ধর্ম মানে না। সাগরের পাড়ে নলখাগড়ার তৈরী কুঁড়েঘরে এরা বাস করে। তাদের প্রচুর কলা ও সুপাড়ির গাছ আছে। এদের পুরুষদের গড়ন আমাদের মতো , শুধু মুখটির আকৃতি কুকুরের মতো। কিন্তু মেয়েদের বেলায় আবার তা নয়। তারা যথেষ্ট সুন্দুরী। পুরুষরা উলঙ্গ থাকে, এমনকি লজ্জাস্থানও আবৃত করে না। সময় সময় নলের তৈরী একটি থলে এদের কোমড় থেকে ঝুলতে দেখা যায়। মেয়েরা গাছের পাতা দিয়ে দেহের সম্মুখভাগ আবৃত রাখে। তাদের মধ্যে ভিন্ন মহল্লায় বাংলা ও সুমাত্রার বহু মুসলমান বাস করে।“
সফরনামা লিখন

মরোক্কোর সুলতান আবু ইনান মারিনির নির্দেশে ইবনে বতুতার পুরো সফরের কাহিনী ও অভিজ্ঞতা লিখনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুলতানের সচিব ইবনে জুজায়ীর কাছে ইবনে বতুতা তার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণ্না করেন। ইবনে জুজায়ী তার কাব্যিক ভাষায় পুরো ভ্রমণ বৃত্তান্ত তুলে ধরেন। সম্পূর্ণ বইটি রেহলা শিরোনামে সংকলিত হয়।
মৃত্যু
ইবনে বতুতার ভ্রমণ সম্পর্কিত রেহলা থেকে আমরা কেবল ১৩৫৫ সাল পর্যন্ত তথ্যাদি পাই। তাই তার মৃত্যুর সঠিক তথ্য নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি ১৩৬৮ সালে মতান্তরে ১৩৭৭ সালে মারা যান।
# ইবনে বতুতার সফরনামা- মোহাম্মাদ নাসির আলী