অবরুদ্ধ ঢাকার মানুষের কাছে “মুক্তিযুদ্ধ” শব্দটি যেন কল্পনার মত। পাক-বাহিনীর গণহত্যা, বিহারী-রাজাকারদের আগ্রাসন, আর্মি চেকপোস্টের অতি তৎপড়তায় ঢাকা যেন এক ভয়াল নগরী। সেই ভয়াল নগরীতে এলো একদল তরুণ। সাথে নিয়ে এলো স্টেনগান, এসএমজি ও গ্রেনেড। পরবর্তী কয়েক মাস গেরিলা হামলায় পর্যদুস্ত করে রাখল পাকিস্তানী আর্মিকে আর সেইসাথে শহরের মানুষের কাছে যেন সত্যি হয়ে ধরা দিল কল্পনায় থাকা মুক্তিযুদ্ধ।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের “একাত্তরের দিনগুলি” দিনলিপিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ সময়ের বিপর্যস্ত ঢাকা এবং ঢাকায় গেরিলাদের তৎপড়তার গল্প সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। সেই সাথে ফুটে উঠেছে সন্তানহারা এক মায়ের বুকের ভেতরে চাপা থাকা আর্তনাদ এবং স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা ও স্পৃহার কথা।
দিনলিপিটি শুরু হয় ১৯৭১ এর মার্চ মাসের উত্তাল ঢাকার প্রেক্ষাপটে যখন বিভিন্ন ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে সারাদেশে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছিল। “সাধারণ পরিষদের অধিবেশন” স্থগিতের ঘটনায় দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ চলমান বিক্ষোভের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করে নিচ্ছিল। ঠিক এই সময় এলিফ্যান্ট রোডের এক বাড়িতে বাস করতেন জাহানারা ইমাম, স্বামী শরীফ ইমাম, দুই পুত্র শফী ইমাম রুমী ও সাইফ ইমাম জামী এবং তার অন্ধ শ্বশুর। জাহানারা ইমামের বড় ছেলে রুমী একই সাথে মেধাবী ও স্বাধীনচেতা এক তরুণ। মার্চ মাসে তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের মিছিল, মিটিং কিংবা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

২৫ শে মার্চ কালোরাতে ঢাকায় পাক-বাহিনীর গণহত্যার পর সকল স্তরের মানুষের মনে স্বাধীনতার চেতনা নতুনভাবে জাগ্রত হয়। মানুষ দলেদলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে গমন শুরু করে। তখন রুমীরও ইচ্ছা হয় দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার। কিন্তু কিছুতেই মা জাহানারা ইমামকে রাজি করাতে পারে না।
শেষমেষ রুমী তার মাকে বলে উঠে, “আম্মা, দেশের এইরকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তা হলে আমার বিবেক চিরকালের জন্য অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?”
তর্কে হেরে মা জাহানারা ইমাম দুচোখ বন্ধ করে বললেন, “না, তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।“
মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরের অধীনে ভারতের আগরতলায় রুমী মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়। ঢাকায় পাক-বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে রাখার জন্য মেজর হায়দারের অধীনে একটি স্পেশাল গেরিলা ইউনিট গঠন করা হয় যা পরবর্তীতে “ক্র্যাক প্লাটুন” নামে পরিচিতি লাভ করে। যাদের মূল কাজ ছিল “হিট অ্যান্ড রান” পদ্ধতিতে গেরিলা আক্রমণ করে পাক-বাহিনীর মনোবল নষ্ট করা এবং সারাবিশ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জানান দেওয়া।
ক্র্যাক প্লাটুনের প্রথমদিকে ঢাকায় অপারেশনের জন্য যে কয়জন তরুণ যোদ্ধাদের নির্বাচন করা হয় তাদের মধ্যে একজন রুমী। এছাড়াও বাকের, বদি, মায়া, আলম, শাহাদাত, জুয়েল, আজাদদের মতো সাহসী তরুণরাও ছিল এই গেরিলা টিমে। এসময় তারা অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, অপারেশন ফার্মগেট চেকপয়েন্ট, অপারেশন গ্রিনরোডের মতো দুঃসাহসিক অপারেশন করে। এছাড়াও বিভিন্ন পেট্রল-স্টেশন ও পাওয়ার প্ল্যান্ট অচল করে দেয় তারা।

এসময় জাহানারা ইমামের বাড়িতেও মাঝেমধ্যে রুমী ও তার সহযোদ্ধারা মিটিং করত। তিনি নিজের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, রসদ, ঔষুধ জমিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকানোর ক্ষেত্রেও তিনি সরাসরি সাহায্য করেন।
২৯ শে আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী নিজ বাসা থেকে শরীফ ইমাম ও তার দুই পুত্র রুমী ও জামিকে গ্রেফতার করে।ঠিক একই দিনে বাকের, বদি, আজাদ, জুয়েলকেও গ্রেফতার করা হয়। তার পরের দিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শরীফ ইমাম ও জামিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও রুমীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। সেই সাথে খোঁজ পাওয়া যায় নি বদি, জুয়েল, বাকের, আজাদদের। সেপ্টেম্বর মাসে ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে সেই সময় রুমীর পরিবার সামরিক জান্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নি। কারণ এতে রুমীর সত্ত্বাকে অপমান করা হয়।

এই দিনলিপিতে একদিকে যেমন দেখা যায়, ছেলেহারা মায়ের বুকফাঁটা আকুতি অপরদিকে দেখা যায় স্বাধীন দেশকে নিয়ে পুষে থাকা সাধারণ মানুষের স্বপ্ন। যুদ্ধের শেষের দিকে ডিসেম্বর মাসে যখন ইন্ডিয়ান বোমারু বিমান ঢাকায় বোম্বিং করছে তখন সাধারণ মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার বদলে রাস্তায় নেমেছে নতুবা বাড়ির সাদে গিয়ে উঠেছে। সবার মধ্যে একটা চাপা আনন্দ কারণ যে কোনো সময় এসে পড়তে পারে স্বপ্নে পুষে রাখা স্বাধীনতা। যুদ্ধের শেষ দিকে এসে মারা যান রুমীর বাবা শরীফ ইমাম। বাবা ও ভাইকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়ে জামি। সে পাকসেনা ও বিহারীদের হত্যা করে ভাই ও পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে উন্মাদ হয়ে উঠে।
যুদ্ধে জয়লাভের পর ১৭ই ডিসেম্বরের দিনলিপিতে জাহানারা ইমাম লেখেন, “সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশী রক্তের দাম দিতে হয়েছে যে কান্নার স্রোতেও হাসি ডুবে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে।“ সমগ্র দেশ একসাথে স্বাধীনতার আনন্দে ভাসছে, কিন্তু অপরদিকে আপনজন হারানোর বেদনায় কাঁদছে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। এটাই হয়তো স্বাধীনতার অনুভূতি, এটাই হয়তো মুক্ত হয়ে বাঁচার অনুভূতি।
