Zoroastrianism

জরাথুস্ট্রবাদ : প্রাচীন পারস্যের একশ্বরবাদ ধর্ম

যুগে যুগে প্রতিটি সভ্যতার বিকাশে ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। প্রাচীন পারস্য সভ্যতাকে আগলে ধরে যে একশ্বরবাদ ধর্মের প্রচলন ঘটে তাই ইতিহাসে জুরাথুস্ট্রবাদ নামে পরিচিত। সমাজবিদদের  মতে, পরবর্তী একঈশ্বরবাদ ধর্মগুলো কিছুটা এই ধর্মমত দ্বারা প্রভাবিত। এমনকি গসপেল অব ম্যাথিও তে তিনজন জরাথুস্ট্র ধর্মযাজকের (ম্যাজাই)  উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা পূর্বদিক থেকে এসেছিলেন শিশু যিশুর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করতে। এখনও ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো এই ধর্মমতের মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়।

জরাথুস্ট্র ও জরাথুস্ট্রবাদের উৎপত্তি

জরাথুস্ট্র, পারস্যের প্রথম একশ্বরবাদ ধর্মের প্রচারক।
জরাথুস্ট্র, পারস্যের প্রথম একশ্বরবাদ ধর্মের প্রচারক।

জরাথুস্ট্রবাদের জনক জরাথুস্ট্র ঠিক কোন সময়ে এই ধর্মমত প্রচার শুরু করেছেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা তে এই নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য নেই। অনেকের মতে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পারস্যের মহান রাজা কুরুসের সমসাময়িক কোনো সময়ে এই ধর্মমতের প্রচার শুরু হয়। তবে ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই ধর্মমত প্রচারের সময়কাল খ্রীষ্টপূর্ব পনেরো শতক থেকে বারো শতকের মধ্যেও হতে পারে।

 জরাথুস্ট্র সর্বপ্রথম পারস্যে একঈশ্বরবাদ ধর্মমতের প্রচলন করলেও সরাসরি বহুঈশ্বরবাদ পুরোনো পারসিক ধর্মমতের বিরোধিতা করেন নি। আসলে জরাথুস্ট্রবাদকে সরাসরি ইহুদী ও ইসলাম ধর্মের মতো একঈশ্বরবাদ ধর্ম বলা যায় না। বলা যায়, জরাথুস্ট্রবাদ প্রাচীন বহুঈশ্বরবাদ ও একঈশ্বরবাদ উভয় প্রথাকেই গ্রহণ করে যার মূল লক্ষ্য ‘আহুরা মাজদা’ কে একক ও সার্বভৌম ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেওয়া।

বিশ্বাস

জরাথুস্ট্রবাদে ‘আহুরা মাজদা’ কে ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করা হয় যিনি আলো-অন্ধকার , ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, জীবন-মৃত্যু রাত-দিন সৃষ্টি করেছেন। এই ‘আহুরা মাজদা’ থেকে সৃষ্ট দুইটি সত্ত্বা হলো স্পেন্টা মাইনু ও অ্যাঙরা মাইনু। স্পেন্টা মাইনু সত্য ও কল্যাণের নির্দেশক এবং অ্যাঙরা মাইনু মিথ্যা ও অকল্যাণের নির্দেশক। জরাথুস্ট্রবাদ ধর্মমতে , মানুষের নৈতিক বা অনৈতিক যে কোনো পথ বাছাই করার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু এই বাছাই চূড়ান্ত পরিণতিতে প্রভাব ফেলবে। নৈতিক পথ মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বেহেশতের দিকে ধাবিত করবে এবং অনৈতিক পথ দোজখের দিকে ধাবিত করবে। জরাথুস্ট্রবাদে ‘আহুরা মাজদা’ কে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে যেমন একশ্বরবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, ঠিক তেমনি স্পেন্টা মাইনু ও অ্যাঙরা মাইনু দুইটি বিপরীত সত্ত্বার উপস্থিতির জন্য দ্বৈতবাদের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। বলা হয়ে থাকে, এই দুইটি সত্ত্বা সমান পরিমাণ শক্তি নিয়ে মহাবিশ্বে অবস্থান করছে এবং মানুষ হলো তাদের হাতে আটকে থাকা খেলনার মতো যে সারাজীবন এই দুই সত্ত্বার কোন দিকে গমন করবে তা নিয়ে লড়াই করে যায়।

জরাথুস্ট্রবাদে আগুন ও পানি হলো শুদ্ধতার প্রতীক। আগুন ও পানিকে জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য মনে করা হতো। এজন্য তাদের অগ্নি মন্দিরগুলোর চারপাশে আগুন ও পানিকে প্রতীকিরুপে তুলে ধরা হয়। এই ধর্মে আগুনের পবিত্রতার সাথে ‘আহুরা মাজদা’ র পবিত্রতার তুলনা করা হয়। আগুন হলো ‘আহুরা মাজদা’ র একটি রুপ বিশেষ। এজন্য এর অনুসারীরা আগুনকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করত। যার ফলে অনেকেই এই ধর্মের অনুসারীদের অগ্নিপূজারি মনে করে। কিন্তু তারা আসলে আগুনকে সামনে রেখে ‘আহুরা মাজদা’ র পূজা করত। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এর মাধ্যমে আধ্যাতিক জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি অর্জিত হয়।

ইরানে অবস্থিত একটি দাখমাহ, যেখানে জরাথুস্ট্রবাদের রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে আকাশ সমাধি করা হত।
ইরানে অবস্থিত একটি দাখমাহ, যেখানে জরাথুস্ট্রবাদের রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে আকাশ সমাধি করা হত।

ধর্মগ্রন্থ

জরাথুস্ট্রবাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হলো আবেস্তা বা জেন্দাবেস্তা। এটি আবেস্তাই ভাষায় রচিত। ধারণা করা হয়, এই ধর্মগ্রন্থের প্রাচীন গাঁথাসমূহ সরাসরি জরাথুস্ট্র থেকে প্রাপ্ত। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাপ্ত ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদের সাথে আবেস্তার অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই থেকে ধারণা করা হয় উভয় ধর্মগ্রন্থ একই উৎস থেকে এসেছে। উভয় ধর্মগ্রন্থে দেবতা ইন্দ্র- এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার ঋগবেদের উল্লেখিত দেবতা মিত্র পারস্যের আবেস্তা গ্রন্থে মিথরা নামে প্রকাশ পায়।

জরাথুস্ট্রদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার একটি পান্ডুলিপি।
জরাথুস্ট্রদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার একটি পান্ডুলিপি।

পারস্য সম্রাজ্যে জরাথুস্ট্রবাদের ভূমিকা

প্রাচীন পারস্যের বুকে শাসন করা তিনটি সম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে জরাথুস্ট্রবাদ টিকে ছিল। আচেমেনিড সম্রাজ্যের মহান রাজা কুরুস তার রাজ্যশাসনে জরাথুস্ট্রবাদের নীতি অনুসরণ করতেন। কিন্তু তিনি কখনও জরাথুস্ট্রবাদকে  মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন নি। এই সময় জরাথুস্ট্রবাদের বিশ্বাস সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীন থেকে সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।

মহাবীর আলেজান্ডার দ্বারা পারস্যে আচেমেনিড সম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং গ্রিকদের উত্থান হয়। কিন্তু পারস্যে গ্রিকরা বেশিদিন অবস্থান করতে পারে নি। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর পার্থিয়ান জাতিগোষ্ঠী দ্বারা গ্রিকরা পারস্য থেকে অপসারিত হয়। এসময় গ্রিক ও পারস্যের মধ্যে সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপক আদান-প্রদান ঘটে। খ্রীস্টপূর্ব ২৪৭ থেকে ২২৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত পার্থিয়ানরা পারস্যের ক্ষমতাবলে ছিল। খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে গ্রিক ও পারসিক উপাস্যের নামের মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- জিউস অরোমাজদেস, অ্যাপোলো মিথরা, হ্যালিয়োস হার্মেস, আর্তানেস হ্যারাক্লেস প্রভৃতি। তুর্কিমিনিস্থানের আশগাবাতে প্রাপ্ত ৪০ অব্দের জরাথুস্ত্রীয় পঞ্জিকা পার্থিয়ান সম্রাজ্যে জরাথুস্ট্রবাদের বিশেষ স্বীকৃতির প্রমাণ করে।

জরাথুস্ট্রদের একটি অগ্নি মন্দির
জরাথুস্ট্রদের একটি অগ্নি মন্দির

২২৪ থেকে ৬৫১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত পারস্যে সাসানীয় সম্রাজ্য চলমান থাকে। আরদাশির-১ যিনি সাসানীয় সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি আচেমেনিড সময়কালের পুরোনো জরাথুস্ট্রবাদকে পুনরায় জাগ্রত করতে উদ্যমী ছিলেন। এই সাসানীয় আমলেই জরাথুস্ট্রবাদের পবিত্র বাণীগুলো সংগ্রহ এবং একত্রিত করা হয়। এতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন তানসার ও কার্তার নামক দুইজন ধর্মতাত্ত্বিক পণ্ডিত। সাসানীয় আমলেই জরাথুস্ট্রবাদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাকে লিখিত রুপে আনার চেষ্টা করা হয় এবং এক্ষেত্রে তারা অনেকটাই সফল হয়। সপ্তম শতকে মুসলিমরা পারস্য জয় করলে সেখানে এই ধর্মতত্ত্বের অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। এরপর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক হতে নবম শতকের মধ্যে এর অনুসারীরা ইরান থেকে ভারতে গমন করে। ভারতে স্থানীয়ভাবে এরা পার্সি নামে পরিচিত।

আচার-অনুষ্ঠান

জরাথুস্ট্রবাদে আগুন ও পানিকে শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এজন্য প্রাচীন এই ধর্মের মন্দিরগুলোর দেয়ালে আগুন ও পানির প্রতীক শোভা পায়। তারা আগুনকে পূজা করার মাধ্যমে আহুরা মাজদা-কে পূজা করে। জরাথুস্ত্রবাদের প্রাচীন উপাসনালয়গুলো টাওয়ারের মতো এবং বর্গাকৃতির। এগুলো চাহারতাক নামে পরিচিত। সমগ্র ইরানে এরকম উপাসনালয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরকম উপাসনালয়ের প্রচলন সাসানীয় সম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই ছিল এবং প্রতিটি উপাসনালয়ে একটি প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখা থাকত যা সবসময় জ্বলত। বলা হয়ে থাকে , এরুপ তিনটি উপাসনালয় রয়েছে যা প্রাথমিক সময় থেকেই সরাসরি আহুরা মাজদা থেকে প্রাপ্ত । এগুলো পবিত্র আগুন হিসেবে পরিচিত।

এই ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষিত হওয়ার জন্য নওজোত নামক একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। সাত বছর হওয়ার আগে কারো নওজোত হয় না। কিন্তু নওজোতের ক্ষেত্রে কোনো উর্ধ্বসীমা নেই।

জরাথুস্ট্রদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নওরোজের একটি ছবি।
জরাথুস্ট্রদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নওরোজের একটি ছবি।

এই ধর্মে আকাশ-সমাধিকরণের মাধ্যমে মৃতদেহ সৎকার করা হয়। কারণ এই ধর্মমতে মৃত্যু অশুভ শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই মৃতদেহ অপবিত্র হয়ে যায়। এই অপবিত্র মৃতদেহ পানি কিংবা আগুনের সংস্পর্শে আসলে এই পৃথিবী অপবিত্র হয়ে যাবে। তাই তারা মৃতদেহ দাখমাতে( উঁচু টাওয়ার) রেখে দেয় এবং শকুনের অপেক্ষায় থাকে। শকুন খুব অল্পসময়ে মৃতদেহ খেয়ে নিঃশেষ করে দেয়। ১৯৭০ সালের পর ইরানে আকাশ-সমাধিকরণ বেআইনী ঘোষণা করা হয়। তাই এখন জরাথুস্ট্রবাদের অনুসারীরা মৃতদেহের নিচে কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে দেহ সমাধি করে। কিন্তু ভারতে বসবাসরত কিছু পার্সিরা এখনও দাখমাতে আকাশ-সমাধি করে থাকে।

বর্তমানে এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার। ভারত, আমেরিকা, কানাডা, ইরাক ও ইরানে কিছু সংখ্যক জরাথুস্ট্রবাদের অনুসারী রয়েছে। ভারতে অবস্থিত এই ধর্মের অনুসারীদের অধিকাংশই মুম্বাইয়ে বসবাস করে। এই ধর্মমত বেহেশত, দোজখ ,বিচারদিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পরজাগতিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটায়, অন্যদিকে বহু দেবতার উপাসনা থেকে বের হয়ে নতুন করে একঈশ্বরবাদী বিশ্বাসের সাথে পারস্য সম্রাজ্যের পরিচয় করিয়ে দেয়। আজকের পারস্যে এই ধর্মমতের মানুষদের হয়তো খুঁজে পাওয়া দুস্কর কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এই জরাথুস্ট্রবাদ ও প্রাচীন পারস্যকে আলাদা আলাদা করে চিন্তা করার কোনো উপায় নেই।

১ /   http://www.humanreligions.info/zoroastrianism.html

২/   https://www.ancient.eu/Ahura_Mazda/

৩/   https://www.history.com/topics/religion/zoroastrianism

৪/   https://www.britannica.com/topic/Zoroastrianism/Iconography

৫/  https://encyclopedia2.thefreedictionary.com/Mazdean

Leave a Comment

Your email address will not be published.